Business

সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম - একজন বর্ষীয়ান নেতা এবং পরিচ্ছন রাজনীতির উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত

পরিচ্ছন্ন রাজনীতির উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। বর্ণাঢ্য এক রাজনৈতিক জীবনের অধিকারী আওয়ামী লীগের এই বর্ষীয়ান নেতা মুজিবনগর সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও জাতীয় চার নেতার অন্যতম সৈয়দ নজরুল ইসলামের ছেলে। ত্যাগী, বিচক্ষণ, দূরদর্শী ও সজ্জনসহ সবদিক থেকেই অনন্য ছিলেন তিনি। সৈয়দ আশরাফ ১৯৫২ সালের ১ জানুয়ারি ময়মনসিংহে জন্মগ্রহণ করেন। ব্যক্তিগত জীবনে সৈয়দ আশরাফ ব্রিটিশ ভারতীয় শীলা ঠাকুরের সঙ্গে বিবাহ-বন্ধনে আবদ্ধ হন। শীলা লন্ডনে শিক্ষকতা করতেন। ২০১৭ সালের ২৩ অক্টোবর তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তাদের একটি মেয়ে রয়েছে (রীমা ঠাকুর), তিনি লন্ডনের এইচএসবিসি ব্যাংকে চাকরি করেন। আশরাফুল ইসলাম ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর একজন সদস্য ছিলেন। ভারতের দেরাদুনে তিনি প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন।
সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম এমএ ডিগ্রি লাভ করেন। পারিবারিক ঐতিহ্যের সূত্র ধরে তিনি ছাত্রজীবন থেকেই রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। ১৯৭০ বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। এ ছাড়াও তিনি কেন্দ্রীয় সহপ্রচার সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন সৈয়দ আশরাফ।
১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে অন্য তিন জাতীয় নেতার সঙ্গে আশরাফুলের পিতা সৈয়দ নজরুল ইসলামকে হত্যা করা হয়েছিল। পিতার মৃত্যুর পর সৈয়দ আশরাফুল যুক্তরাজ্যে চলে যান এবং লন্ডনের হ্যামলেট টাওয়ারে বসবাস শুরু করেন। লন্ডনে বসবাসকালে তিনি বাংলা কমিউনিটির বিভিন্ন কার্যক্রমে জড়িত ছিলেন। সে সময় তিনি লন্ডনস্থ বাংলাদেশ যুবলীগের সদস্য ছিলেন। আশরাফুল ফেডারেশন অফ বাংলাদেশি ইয়ুথ অর্গানাইজেশন (এফবিওয়াইইউ) এর শিক্ষা সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন। সে সময় তিনি লন্ডনস্থ বাংলাদেশ যুবলীগের সদস্য ছিলেন।
১৯৯৬ সালে আশরাফুল দেশে ফিরে আসেন এবং জুন ১৯৯৬ সালের ৭ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলা নিয়ে গঠিত কিশোরগঞ্জ-১ আসন থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন এবং বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ২০০১ সালে পুনরায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ২০০১ থেকে ২০০৫ পর্যন্ত তিনি পররাষ্ট্র বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ছিলেন।
ওয়ান-ইলেভেন পরবর্তী (২০০৭) আওয়ামী লীগের দুঃসময়ে জিল্লুর রহমানের (প্রয়াত রাষ্ট্রপতি) সঙ্গে মিলিত হয়ে তিনি দলের হাল ধরেছিলেন। দলকে সঠিক পথে এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছেন। যখন আবদুল জলিল গ্রেফতার হন, তখন সৈয়দ আশরাফ আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এ সময় তিনি সংকটের মুখে পড়া আওয়ামী লীগ এবং জাতীয় রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। একই সঙ্গে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনাকে রাজনীতি থেকে বিতাড়নের যে খেলা তখন চলেছিল, তার বিরুদ্ধেও সোচ্চার ছিলেন তিনি।
পরবর্তিতে ২০০৮ সালের সাধারণ নির্বাচনে (নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন) তিনি আবারো বিপুল ব্যবধানে নির্বাচিত হয়ে সংসদ সদস্যপদ লাভ করেন এবং ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে নতুন মন্ত্রিসভা গঠিত হলে তিনি স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান। একই বছর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পান সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। দলের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন ২০১৬ সাল পর্যন্ত। এরমধ্যে ২০১৪ সালের দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পুনরায় সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন।
দশম জাতীয় নির্বাচনের পর পুনরায় আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে সৈয়দ আশরাফ একই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ২০১৫ সালের ৯ জুলাই তাকে দফতরবিহীন মন্ত্রী করা হয়। এর মাত্র এক মাস এক সপ্তাহ দফতরবিহীন মন্ত্রী থাকার পর একই বছরের ১৬ জুলাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাকে নিজের অধীনে রাখা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সম্পূর্ণ দায়িত্ব প্রদান করেন।
ফুসফুসের ক্যান্সারে আক্রান্ত হলে চিকিৎসার জন্য গত বছরের ১৮ সেপ্টেম্বর সংসদ থেকে ছুটি নেন। এরপর থেকে সৈয়দ আশরাফ থাইল্যান্ড ব্যাংককের বামরুনগ্রাদ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। তিনি দেশে না থাকলেও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেন। কিশোরগঞ্জ-১ (কিশোরগঞ্জ সদর ও হোসেনপুর উপজেলা) আসনে নৌকা প্রতীক নিয়ে বিপুল ভোটে জয়ী হন। কিন্তু থাইল্যান্ডে চিকিৎসাধীন বৃহস্পতিবার (৩ জানুয়ারি) রাতে ৬৭ বছর বয়সে না ফেরার দেশে চলে যান বর্ষীয়ান এই রাজনীতিবিদ। তার মৃত্যুতে বিভিন্ন মহলে নেমে এসেছে শোকের ছায়া। সৈয়দ আশরাফকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করে আওয়ামী লীগের নেতারা বলেছেন, তিনি একজন পরিচ্ছন্ন রাজনীতিবিদ ছিলেন। সাধাসিধে জীবনযাপনে অভ্যস্ত সৈয়দ আশরাফ ছিলেন নির্লোভ ও নিরহংকারী। নেত্রী ও দলের প্রতিও তিনি ছিলেন অবিচল। তার মতো ত্যাগী, বিচক্ষণ, দূরদর্শী ও সজ্জন রাজনীতিকের শূন্যতা কখনোই পূরণ হওয়ার নয়।

Post a Comment

0 Comments

class="fb-customerchat" "attribution"=setup_tool page_id="226269794967384">